স্বদেশ ডেস্ক:
রাজধানীর মিরপুর ১৩ নম্বর সেকশনের একটি ফ্ল্যাটের শোবার ঘরের খাটের ওপর মা-ছেলের নিথর দেহ, কাঁথায় জড়ানো। তাদের ঘিরে ছড়ানো অসংখ্য ফুল। ছেলের বুকের ওপর মায়ের আদর বুলানো হাত আর কোরআন শরিফ। বিছানার শেষ প্রান্তে ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় ঝুলে আছেন বাবা। দেয়াল, ড্রেসিং টেবিলে সাঁটানো ও সারা ঘরে ছড়ানো-ছিটানো অর্ধশতাধিক চিরকুট। গত বৃহস্পতিবার গার্মেন্টস ব্যবসায়ী এসএম বায়েজীদ (৪৫), স্ত্রী কোহিনুর পারভীন ওরফে অঞ্জনা (৪০) ও তাদের একমাত্র সন্তান এসএম ফারহানের (১৭) মরদেহ এভাবেই পড়েছিল। তদন্তের স্বার্থে চিরকুটগুলোকে আলামত হিসেবে জব্দ করেছে পুলিশ।
চিরকুটের উক্তি বিশ্লেষণ করে পুলিশ ও নিহতের স্বজনরা ধারণা করছেন, ঋণে জর্জরিত বায়েজীদ চরম হতাশাগ্রস্ত ছিলেন। বুধবার রাতে খাবারের (বিরিয়ানি) সঙ্গে বিষ মিশিয়ে কৌশলে তা খাইয়ে স্ত্রী-সন্তানকে আগে হত্যা করেন তিনি। গভীররাতে দীর্ঘ সময় ধরে
ঠা-া মাথায় দুই লাশ অন্য ঘর থেকে টেনেহিঁচড়ে এনে শোয়ান ফুল ছিটানো বিছানায়। এর পর লাশের ওপর কাঁথা দিয়ে তার ওপর আবার ফুল ছিটান এবং মা ও ছেলের বুকে রাখেন দুটি কোরআন শরিফ। চিরকুটগুলো লেখার সময় নিজেও বিষ পান করেন। তবে সেই বিষে কাজ না হওয়ায় পরে ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন বায়েজীদ। যা- ‘বিষ দিয়ে কাজ হল না, তাই অন্যভাবে চেষ্টা করছি।’ লেখা চিরকুটেই অনেকটা স্পষ্ট।
তবে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ভাবিয়ে তুলছে লাশের ঘর থেকে জব্দকৃত একটি পাঁচ লাইনের চিরকুট। ছোটাকৃতির হলুদ কাগজে লেখা রয়েছে- ‘আমার বিবাহিত জীবনের প্রথম ফার্নিচার, ৩০ বছর আগে দুজন মিলে কিনেছিলাম, তাই দেখতে ভালোই লাগে।’ ভাবনার কারণ হিসেবে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৪৫ বছর বয়সী বায়েজীদ ও ৪০ বছর বয়সী অঞ্জনার বিয়ে হয় প্রায় ২০ বছর আগে। বিয়ের তিন বছর পর তাদের ঘর আলো করে জন্ম নেয় ফারহান। নিহতের স্বজনদের দেওয়া এ তথ্যের ভিত্তিতে ধরে নেওয়া যায়- বিয়ের সময় বায়েজীদের বয়স ছিল ২৫, আর অঞ্জনার ২০ বছর। কিন্তু সুইসাইডাল নোটে ‘বায়েজীদের’ লেখা চিরকুট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- ওই দম্পতি বিবাহিত জীবনের প্রথম ফার্নিচার যদি ৩০ বছর আগে কিনেন, তা হলে বায়েজীদের বয়স তখন ১৫ বছর থাকার কথা আর অঞ্জনার ১০। এর আগে আবার তারা দীর্ঘদিন প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। ফলে জোরালো প্রশ্ন উঠছে, আদৌও কি মৃত্যুর আগে বায়েজীদ চিরকুটগুলো লিখেছিলেন? নাকি প্রকৃত ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে ‘ত্রিপল মার্ডার’কে কোনো একটি পক্ষ ‘ডাবল মার্ডার, ওয়ান সুইসাইড’ হিসেবে প্রচার করছে। যদিও এখনই এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো মত না দিলেও চিরকুটেই যে হত্যার রহস্য লুকিয়ে রয়েছে, তা বদ্ধমূল ধারণা তদন্ত সংশ্লিষ্টদের। সব দিক বিবেচনায় নিয়েই নিবিড় তদন্ত চলছে বলে তারা জানান।
পুলিশ সূত্র জানায়, ব্যবসায়ী বায়েজীদের বাসার চারটি রুম, বাথরুমসহ সব জায়গায় ছোট ছোট চিরকুট ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিল। সবার ছবি দিয়ে সাজানো অ্যালবাম পড়েছিল মেঝেতে। এর মধ্যে কিছু চিরকুটে লেখা ছিল- ‘সরি’; রান্নাঘরে পড়ে থাকা একটি চিরকুটে লেখা ছিল- ‘এই ঘরে আর কোনোদিন আলো জ্বলবে না’; ‘আজকেই শেষ দিন আমাদের’; ‘উই আর ভেরি সরি’; ‘আমাদের মৃত্যুর জন্য অন্য কেউ দায়ী নয়’। দরজায় লেখা ছিল- ‘আজ আমাদের শেষ বাসরঘর’; ‘আমাদের এমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না’; ‘বিষ দিয়ে কাজ হল না, তাই অন্যভাবে চেষ্টা করছি’; ‘অঞ্জনা সন্ধ্যা থেকে ঘুম থেকে ওঠার আগ পর্যন্ত এই লাইটটা জ্বালিয়ে রাখত, এটা নাকি অন্ধকারের বাতি। জানি না, বাকি দিনগুলোতে কোনো অন্ধকারের বাতি পাবে কি না’। এ ধরনের অসংখ্য চিরকুট ছাড়াও গত বুধবার রাতে বায়েজীদ তার বন্ধুদের ‘ভালো থেকো বন্ধু’ লিখে খুদেবার্তাও দিয়েছিলেন। এ ছাড়া ভোর ৪টা ৩৪ মিনিটে ফেসবুকে তার শেষ পোস্ট ছিল- ‘এভাবেই যেন হাতে হাত ধরে থাকতে পারি অনন্তকাল’।
এদিকে গতকাল শুক্রবার দুপুরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল মর্গে বায়েজীদ ও তার স্ত্রী-সন্তানের লাশের ময়নাতদন্ত করেন সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রভাষক একেএম মইনউদ্দিন। সকাল ১০টা থেকে শুরু হয়ে তা শেষ হয় দুপুর ১টার দিকে। ময়নাতদন্ত শেষে প্রভাষক মইনউদ্দিন বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছেÑ তিনজনই বিষ পান করেছেন। এর মধ্যে বাবা ফাঁস দিয়ে মারা যান। তিনটি মরদেহ থেকেই ভিসেরা সংগ্রহ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে কিডনি, লিভার, পাকস্থলী থেকে টিস্যু সংগ্রহ করা হয়েছে। এ ছাড়া বায়েজীদের গলায় একটি দাগ ছিল। তার মুখে বিষের গন্ধও মিলেছে। পাশাপাশি স্ত্রী ও তার ছেলের পাকস্থলীতেও পাওয়া গেছে বিষের গন্ধ। তিনজনেরই ভিসেরা সংগ্রহ করে রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য মহাখালীতে (সিআইডি ল্যাবে) পাঠানো হয়েছে। কেমিক্যাল পরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়ার পর মৃত্যুর সঠিক কারণ বলা যাবে।’ সব হাতে পেলে, পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে জানান ফরেনসিক বিভাগের এ চিকিৎসক।
কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সেলিমুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, ‘একই পরিবারের তিনজনের মৃত্যুর ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল মর্গে লাশের ময়নাতদন্ত শেষে শুক্রবার বিকালে স্বজনদের কাছে মরদেহগুলো হস্তান্তর করা হয়। তাদের মৃত্যুর কারণ এখনো পরিষ্কার নয়। তবে তৈরি পোশাক ব্যবসায় ক্রমাগত লোকসানের কারণে ঋণগ্রস্ত বায়েজীদ দীর্ঘদিন ধরেই হতাশা ও বিষণœতায় ভুগছিলেন বলে স্বজনদের ভাষ্য। ওই ফ্ল্যাট থেকে বেশকিছু আলামতও সংগ্রহ করা হয়েছে। জব্দ চিরকুটগুলোতেও বায়েজীদের বিভিন্ন হতাশার কথা উল্লেখ করা আছে। তাই ধারণা করা হচ্ছে, ঋণের ভার সইতে না পেরেই হতাশার জন্ম। সে কারণে বুধবার রাতের কোনো এক সময় তিনি তার স্ত্রী ও সন্তানকে বিষ খাইয়ে হত্যার পর নিজে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তবে ঠিক কী কারণে এমনটা ঘটেছে, তা তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত বলা সম্ভব নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘হাতে লেখা চিরকুটগুলো বায়েজীদের লেখা কিনা, তা অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি খতিয়ে দেখছে। অন্য কোনো প্রশ্নের উদ্রেগ হলে সেগুলোও তদন্তে গুরুত্ব পাবে।’